Tuesday , 17 September 2024

গোলাম মুরশিদের শেষ দিন গুলো

গোলাম মুরশিদ বাংলা সাহিত্যের নন্দিত গবেষক।২২ আগস্ট মারা গেছেন তিনি।আজ লন্ডনে তাঁকে সমাহিত করা হবে। তাঁর শেষ দিনগুলো কেমন ছিল, এই লেখায় তাঁর স্বজন বিধান চন্দ্র পাল লিখেছেন সেই বৃত্তান্ত।কাছে কিংবা দূরে থেকে একজন লেখককে ভালোবাসতে পারেন পাঠক, কিন্তু লেখকের ভালোবাসা পাওয়া ও স্নেহধন্য হওয়ার সৌভাগ্য হয় খুব কম মানুষেরই। আমার ক্ষেত্রে হয়েছিল দুটোই। লেখকের লেখাকে ভালোবেসে, লেখকের সম্পর্কে কাছাকাছি গিয়ে পরম সৌভাগ্য অর্জন করেছিলাম, আবিষ্কার করেছিলাম অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী একজন মানুষকে। তিনি আর কেউ নন, সবার সুপরিচিত গবেষক ও লেখক অধ্যাপক গোলাম মুরশিদ।

গোলাম
গোলাম মুরশিদের শেষ দিন গুলো

যে সম্পর্কের শুরুটা হয়েছিল আজ থেকে বিশ বছরেরও বেশি সময় আগে, সেই সম্পর্ককেই গোলাম মুরশিদ ২০১৯ সালে এসে ‘বাংলা ভাষার উদ্ভব ও অন্যান্য’ গ্রন্থটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘পুত্রপ্রতিম’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। অর্থাৎ আমি তাঁর পুত্রের সমতুল্য, সেই মর্যাদার আসনে তিনিই আমাকে বসিয়েছিলেন। প্রকৃত অর্থে তিনি ও তাঁর সহধর্মিণী এলিজা মুরশিদ সব সময়ই বলতেন, আমি তাঁদের বাংলাদেশের সন্তান। তাঁর মতো ব্যক্তিত্বের কাছে থেকে এই স্বীকৃতি অর্জন করা কতটা সম্মানের, দায়িত্বের ও গৌরবের হতে পারে, তা কেবল তাঁকে যাঁরা গভীরভাবে চেনেন, জানেন; তাঁরাই কেবল উপলব্ধি করতে পারবেন।

তিনি ছিলেন আমাদের অত্যন্ত কাছের ও প্রিয়। তাই আমি ও আমার সহধর্মিণী ডালিয়া দাস আমরা দুজনেই তাঁকে ‘কাকু’ বলে সম্বোধন করতাম। কাকু হলেও তিনি আসলে আমাদের কাছে ছিলেন পিতৃসমতুল্য এবং আমার বিবেচনায় একজন আদর্শ পিতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। প্রসঙ্গত, ডালিয়াকেও কাকু তাঁর অন্যতম একটি গ্রন্থ উৎসর্গ করেছিলেন। ‘নারী ধর্ম ইত্যাদি’ গ্রন্থের উৎসর্গ অংশে তিনি লিখেছিলেন: ‘ডালিয়া দাস এবং আমার তাবৎ নারীদরদী/নারীবাদী এবং অসাম্প্রদায়িক পাঠক-পাঠিকাদের, যাঁদের দেখিনি, কিন্তু যাঁদের সঙ্গে একাত্মবোধ করি।’

২০২৪ সালের ২২ আগস্টের পর থেকে কাকুর সঙ্গে আমাদের সরাসরি আর কোনো কথা হবে না, কোনো দিন আর দেখাও হবে না। তিনি শারীরিকভাবে সবাইকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পরেও লেখকের প্রতি ভালোবাসার সেই সম্পর্কটা আমার সঙ্গে অটুটই থেকে যাবে।

কথা প্রসঙ্গে এবং আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকারেও একাধিকবার কাকু উল্লেখ করেছিলেন, ‘যেদিন আমি লিখতে পারব না, সেদিন আমি বিদায় নেব।’ অন্যভাবে আরেকবার তাঁর আশিতম জন্মবার্ষিকীর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি বলিষ্ঠভাবে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘আমি সত্যি সত্যি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করতে চাই।’ কথাটি তিনি যে বলার জন্য বলেছিলেন, তা নয়। একজন পেশাদার গবেষক হিসেবে তিনি এই প্রতিজ্ঞার কথা উল্লেখ করেছিলেন। বলা বাহুল্য, প্রায় প্রতিদিনই আমার সঙ্গে কথা হতো কাকুর। কখনো স্বল্প সময়, আবার কখনোবা দীর্ঘ সময়ের জন্য। প্রতিদিন আমার কাছে থেকে তিনি দেশের সার্বিক খবর নিতেন। কারণ, বাংলাদেশের প্রতি গভীর এক মমত্ববোধ ও দেশপ্রেম ছিল তাঁর ভেতরে। চল্লিশ বছরের অধিককাল প্রবাসীজীবনে (১৯৮৪ সালে লন্ডনের বিবিসি বাংলা বিভাগে কাজ শুরু করেছিলেন তিনি) প্রায় প্রতিবছরই তিনি কখনো একা, কখনো সহধর্মিণীকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন এবং বছরের বেশির ভাগ সময়ই, অর্থাৎ ক্ষেত্রবিশেষে তিন থেকে ছয় মাস তিনি দেশেই থাকতেন। কারণ, বাঙালির প্রতি, বাংলা ভাষার প্রতি এবং বাংলাদেশের মানুষের প্রতি এক অন্য রকমের দরদ ও দায়বদ্ধতা ছিল তাঁর মনে। তবে বিভিন্ন কারণেই গত দুই বছর বাংলাদেশে আসা তাঁর পক্ষে আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কিন্তু দেশে আসার বাসনা ছিল প্রচণ্ড।

আগস্ট মাসের শেষ দিকটায় হাসপাতালে ভর্তির আগে যখন তিনি লন্ডনের ইলফোর্ডের ডফডেল অ্যাভিনিউয়ের বাসায় ছিলেন, তখনো প্রতিক্ষণ তিনি নিজেকে কর্মব্যস্ত রাখতেই সচেষ্ট ছিলেন। পারকিনসন্স থাকার কারণে অনেক সমস্যা হতো তাঁর। কম্পিউটারে টাইপ করতে অসুবিধা হতো, কিন্তু তারপরও সব সময় কম্পিউটার খুলে নিয়ে লেখাপড়া করতেন এবং সাধ্যমতো লেখার কিংবা বানান সংশোধনের প্রচেষ্টা করে যেতেন। একদিকে ভেতরে–ভেতরে লেখার দুর্নিবার ইচ্ছা, অন্যদিকে লিখতে না পারার অক্ষমতা কাটিয়ে ওঠার জন্য প্রাণান্ত প্রচেষ্টা, এমনই ছিল তাঁর শেষ দিনগুলো।

তিনি নিয়মিতভাবে ব্যায়াম, হাঁটা ও চলাফেরা করতেন। নিজের চিন্তাকে শাণিত রাখতে বিভিন্নজনের সঙ্গে সাহিত্য ও লেখালেখি নিয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। নিজেকে সব সময় সচল রাখতে চাইতেন, যাতে লেখালেখিটা চালিয়ে যেতে পারেন। তাঁর মতে, বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষই একটা বয়সের পর অবসর নিয়ে খুব দ্রুতই বুড়ো হয়ে যায়। তিনি বলতেন, অবসরজীবনই আসলে প্রকৃত কর্মের জীবন, অবসরজীবনকে যাঁরা যতটা কর্মব্যস্ততায় ও অর্থপূর্ণভাবে কাটাতে পারেন, তাঁদের জীবন ততই দীর্ঘ হতে পারে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তিনি কখনোই বুড়ো হতে চাননি। এ জন্য সব প্রজন্মের সঙ্গেই তাঁর ছিল ঘনিষ্ঠ এক আত্মিক সম্পর্ক, বিশেষভাবে ছিল তরুণসমাজের সঙ্গে।

তাঁর ৩৪টি মৌলিক গ্রন্থের মধ্যে ‘বাঙালি নারীদের ইতিহাস’, ‘Retuctant Debutante: Response of Bengali Women to Mordernization’ এবং ‘নারীপ্রগতির এক শ বছর: রাসসুন্দরী থেকে রোকেয়া’ বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মানবীবিদ্যা চর্চায় সমাদৃত হয়েছে। তাঁর রচিত মাইকেল-জীবনী ‘আশার ছলনে ভুলি’ এবং নজরুল-জীবনী ‘বিদ্রোহী রণক্লান্ত’ সমগ্র বাংলা জীবনী সাহিত্যে মাইলফলক বলে বিবেচিত হয়। ‘আঠারো শতকের বাংলা গদ্য’ ও ‘কালান্তরে বাংলা গদ্য’ বাংলা গদ্যের অজ্ঞাত ইতিহাস উন্মোচন করেছে। তাঁর ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’ বইটিকে সমালোচকেরা চিহ্নিত করেছেন অনন্য গ্রন্থ হিসেবে। ‘রেনেসন্স বাংলার রেনেসন্স’ গ্রন্থটি বঙ্গীয় রেনেসন্স সম্পর্কে একেবারে নতুন মূল্যায়ন। বাঙালি ও অবাঙালি মননশীল ব্যক্তিদের মধ্যে তিনি বিশেষভাবে যাঁদের সান্নিধ্যে এসেছেন, তাঁদের নিয়ে রচনা করেছেন ভিন্নধর্মী জীবন-নকশা—‘আলোকিত মুখচ্ছবি’। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বিলেতে বাঙালিদের ইতিহাস ইত্যাদি নানা বিষয়ে তাঁর গবেষণা। তাঁর আরেক অসামান্য কাজ বাংলা ভাষার সর্ববৃহৎ অভিধান ‘বাংলা একাডেমি বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান’ সম্পাদনা। তিনি এ ধরনের অনেকগুলো বড় কাজ, অর্থাৎ পথিকৃতের কাজ করেছিলেন। সেগুলোর মধ্যে ‘বিদ্যাসাগর’, ‘বাংলা ভাষার উদ্ভব ও অন্যান্য’, ‘মাইকেলের দু শ বছর’, ‘রবীন্দ্রনাথের নারী ভাবনা’, ‘বাংলা গানের ইতিহাস’ ইত্যাদি অন্যতম।

বহুদিনের প্রচলিত ধারণাগুলো তিনি যুক্তি ও প্রমাণ দিয়ে নতুন সত্য, নতুন একজন ব্যক্তি মানুষের স্বরূপকে তুলে ধরেছেন। তাঁর কাছে ভালোবাসা, ভালোলাগা, শ্রদ্ধাবোধ, বিশ্বাস এই শব্দগুলো শুধু শব্দ ছিল না। তিনি এগুলো নিজস্ব কিছু মানদণ্ডের বিচারে বা মাপকাঠিতে মূল্যায়ন করতেন। যে কারণে মানুষভেদে তার প্রতি ভালোবাসা, ভালোলাগা, বিশ্বাস এমনকি শ্রদ্ধাবোধও ওঠানামা করত। অন্ধ অনুকরণের বোধ থেকে বের হয়ে এসে যুক্তি, নির্ভরযোগ্য প্রমাণসহ তাঁর রচিত জীবনী সাহিত্যগুলো যদি ভালোভাবে ও মনোযোগ দিয়ে কেউ পড়েন, তাহলে কেউই আর নেতিবাচক সমালোচনা কিংবা সেসব নিয়ে বিতর্ক করার সুযোগ আর পাবেন না বলেই আমার বিশ্বাস।

‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’, ‘বিলেতে বাঙালির ইতিহাস’, ‘আঠারো শতকের গদ্য’, ‘মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর’, ‘বাংলা গানের ইতিহাস’সহ যেসব ঐতিহাসিক গ্রন্থ তিনি রচনা করেছেন, তাঁর প্রতিটি গ্রন্থের জন্যই তিনি অসংখ্য পুরস্কার ও স্বীকৃতির দাবিদার। কিন্তু তিনি কখনোই কোনো পুরস্কারের আশায় কিংবা নেশায় কাজ করেননি। বলা বাহুল্য, ঐতিহাসিক সেই গ্রন্থগুলোয় তিনি যুগের পর যুগ ধরে লালিত এবং স্বীকৃত ব্যাখ্যা ও তথ্যকে নির্ভরযোগ্য তথ্য ও উপাত্তসহ বিশ্লেষণ করে প্রকৃত সত্য উন্মোচন করেছেন। ফলে প্রকৃত পাঠক, প্রকৃত গবেষক ও প্রকৃত অর্থে সমালোচক যাঁরাই আছেন, তাঁরাই এর যথোপযুক্ত মর্যাদা দিতে পারবেন। প্রসঙ্গত, গ্রন্থের লেখা ও মানের তুলনায় অন্যান্য বিবেচনা, অর্থাৎ ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, রাজনৈতিক বিবেচনাসহ যেসব অসুস্থ চর্চা ও সংস্কৃতি এপার বাংলা এবং ওপার বাংলায় গড়ে উঠেছে সেটাকে তিনি সব সময়ই অপছন্দ করতেন।

জীবনের শেষ দিকটাতে সহধর্মিণীর মরণব্যাধি ক্যানসার চিহ্নিত হওয়া নিয়ে এবং সে–সম্পর্কিত চিকিৎসা নিয়ে তিনি খুবই উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত ছিলেন এ কথা সত্যি, একই সঙ্গে সমানভাবে তাঁকে কষ্ট দিয়েছে, ভেতরটা চুরমার করে যন্ত্রণায় ছটফট করেছেন না লিখতে পারার জন্য।জীবনের শেষ প্রান্তে এসে একেবারেই ভিন্নভাবে নিজের জীবনীগ্রন্থ রচনার কাজ অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে শুরু করেছিলেন, কিন্তু তা তিনি শেষ করে যেতে পারলেন না। এর মাধ্যমে আমি বলব, পাঠক আসলে বঞ্চিত হলেন তাঁর মতো একজন অসাধারণ লেখক, গবেষক ও সাহিত্যিকের জীবন সম্পর্কে জানার সুযোগ থেকে।

মৃত্যুর এক দিন আগেও আমার সঙ্গে গভীর রাত পর্যন্ত প্রায় দেড় ঘণ্টা কথা হয়েছিল কাকুর। লন্ডনের কুইন্স হসপিটালের বিছানায় শুয়ে থেকেও তিনি জীবনীগ্রন্থ রচনার যে দায়িত্ব হাতে নিয়েছিলেন সেটাকে শেষ করতে চেয়েছিলেন, কলকাতার সাবেক পুলিশ কমিশনার এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব তুষার তালুকদার সম্প্রতি না–ফেরার দেশে চলে গেছেন। ফলে তাঁর স্মরণে একটি ভিডিও স্মৃতিচারণা প্রদান করতে চেয়েছিলেন তিনি।

আজ ২৬ আগস্ট লন্ডনে গোলাম মুরশিদকে সমাহিত করা হবে। আমার বিশ্বাস, তিনি আছেন, থাকবেন—সব বস্তু ও সত্যনিষ্ঠ লেখা ও গবেষণার মধ্যে, প্রকৃত সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার মধ্যে তিনি বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। সবশেষে রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে ইচ্ছা হয়, ‘সমুখে শান্তিপারাবার—ভাসাও তরণী হে কর্ণধার।’ তাঁর প্রতি জানাই আমার গভীর ও আন্তরিক ভালোবাসা ও অনন্ত শ্রদ্ধা।

সূত্রঃপ্রথম আলো।

 

ত্রাণ নিয়ে কুমিল্লাবাসির কিছু কথা ; প্রথম আলো

নাজমূল আবেদীন ও সাকিব আল হাসান

 

ফেসবুক পেজ

মূলত যৌন জীবনকে সুস্থ্য, সুন্দর ও সুখময় করে তোলার জন্য জানা অজানা অনেক কিছু তুলে ধরা হয়।

এরপরও আপনাদের কোর প্রকার অভিযোগ থাকলে Contact Us মেনুতে আপনার অভিযোগ জানাতে পারেন,

আমরা আপনাদের অভিযোগ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করব।

Spread the love

Check Also

যৌন সুস্থতা

যৌন সুস্থতা, সর্বাঙ্গীণ সুস্থতায় ১০টি টিপস

যৌন সুস্থতা এক সময়কার অনেক বড় একটা ট্যাবু হলেও এখন কিন্তু আর নয়। শারিরীক, মানসিক, …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *