Saturday , 13 September 2025

বিয়ের জন্য নৌকা তৈরি করতে হয় যে উপজাতি নারীদের!

পৃথিবীতে নানা ভাষাভাষীর অনেক জাতি উপজাতি এর বসবাস। সব দেশের উপজাতি দের রয়েছে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য। যা একটি অন্যটির থেকে ভিন্ন। একেক জাতি তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে জীবনযাপন করে। তবে সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে অনেক জাতি আজ প্রায় বিলুপ্তের পথে।
তেমনি এক উপজাতির কথাই থাকছে আজকের লেখায়। তাদের জীবনযাত্রা এবং ঐতিহ্য আপনাকে রীতিমতো অবাক করে দেবে। নানা কুসংস্কার আর ভ্রান্ত বিশ্বাসে তারা আচ্ছন্ন। যা তাদের বিলুপ্তপ্রায় জাতির তালিকায় স্থান দিয়েছে। চলুন তবে জেনে নেয়া যাক এই উপজাতি সম্পর্কে।

 

নৌকা
বিয়ের জন্য নৌকা তৈরি করতে হয় যে নারীদের!

 

 

বিয়ের জন্য নৌকা তৈরি করতে হয় যে নারীদের!

 

মিয়ানমারের মাইক দ্বীপপুঞ্জে বসবাস করা এ জাতি সেলুন উপজাতি হিসেবেই পরিচিত। সেলুনরা মূলত যাযাবর প্রকৃতির। তাদের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উৎস হলো মাছ ধরা। কাবাং নামে নিজেদের হাতে কারুকাজ করা ছোট নৌকায় তারা সমুদ্রে ঘুরে বেড়ায়। মাছের মতো সাঁতার কাটা আর ডুব দিয়ে নদীর এপার থেকে ওপারে চলাফেরা করা তাদের নিত্যদিনের কর্মকাণ্ড। সমুদ্রের জিপসি বা সমুদ্রের পুরুষ হিসেবেও পরিচিত সেলুনরা।

 

সেলুনরা এভাবেই সমুদ্রের উপকূলে বসবাস করে

শুরুতে মালয় উপদ্বীপে বসতি স্থাপন করেছিল এই উপজাতি। সেখানে মারুডাররা তাদের আক্রমণের পর মালয় ছেড়ে পালিয়ে মাইকে চলে আসে তারা। এখানে ৮০০ এর বেশি দ্বীপ রয়েছে। তবে সেলুনরা সাধারণত মাইক এবং কাওথৌং জেলার কাছাকাছি মাইক, কাওথৌং, কিউনসু, পুলাও এবং তানিনথাইয়ের অঞ্চলেই বেশি থাকে। ১৭৭৫ সালে মরিস কলিসের লেখা ‘সিয়ামেস হোয়াইট’ এবং ভংগ্রয়ের ট্র্যাভলগি বইয়ে এই উপজাতিদের উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়াও লেখক লুইয়ের ‘ট্রাইবস ইন মায়ানমার’ প্রবন্ধে সেলুনজাতির উল্লেখ রয়েছে।

জানা যায়, তিব্বত-মায়ানমার, সোম-খমের এবং থাই-চীনাসহ মালেশিয়ার কিছু অংশে সেলুন উপজাতিরা বসবাস করে। সেলুন এবং সোম-খেমার প্রাচীন যুগে একে অপরের সঙ্গেই ছিল। এতে বোঝা যায়, সেলুন একসময় জারগন উপজাতির সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। যাদেরকে আদিম মালয়েশিয়ান বলে মনে করা হত। জারগন উপজাতিদের ওড়ং বুকিট (উচ্চভূমি) এবং ওরাঙে দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছিল। লাউট (সমুদ্রের জিপসি), এতে সেলুন উপজাতি অন্তর্ভুক্ত ছিল।

সেলুনদের ভাষা

তাদের উপভাষা মালয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। সেলুনরা চার ধরনের উপভাষা ব্যবহার করে। ওয়াল্টার হোয়াইট রচিত ‘সি জিপসিজ অব মালায়া’ বইয়ে এ তথ্য পাওয়া যায়। ১৮৪৬ সালে ডা. ব্র্যাকেন জনাব স্টিভেনের নোটগুলো নিয়ে গবেষণা চালায়। এরপর তিনি তা থেকে সেলুন উপজাতিদের জন্য একটি ভাষার সংকলন করেছিলেন। যা এ বি এম প্রেসে প্রকাশিত হয়েছিল।

 

নিজে নিজেেই ভ্রুর আকার ঠিক করবেন যেভাবে

বৃষ্টিতে স্নিকার্স সুরক্ষিত রাখবেন যেভাবে

তাদের নিজস্ব কোনো ভাষাও নেই

তবে সেলুনরা এই ভাষা শিখতে তেমন আগ্রহী ছিল না। আবার ১৯০০ সালে, খ্রিস্টান মিশনারীরা ডা. ডেইজি, নওয়া সেবে এবং নও ফো হলা ইংলিশ এবং পোহ কারেন বর্ণমালার সঙ্গে সেলুনদের ভাষা তৈরি করেন। এমনকি আমেরিকান একটি মিশনারি রোমান বর্ণমালা ব্যবহার করে ‘আ প্রাইমার অব দ্য সেলুন ল্যাঙ্গুয়েজ’ আবিষ্কার করেন। তবে তাদের এখনো নিজস্ব ভাষা নেই।

সেলুনদের জীবিকা

জীবিকা নির্বাহ করতে সেলুনরা কাবাং নামে একটি ছোট নৌকায় করে সমুদ্রে ঘুরে বেড়ায়। আবহাওয়া ভালো থাকলে কাবাংয়ে কখনো পুরো পরিবার সমেত ঘুরে বেড়ান তারা। বর্ষাকালে তারা দ্বীপের কিনারায় কুঁড়েঘর তৈরি করে আশ্রয় নেয়। সেলুনরা সাঁতার কাটা এবং গভীর জলে ডুব দিতে বেশ পারদর্শী। তবে সেলুনরা বর্তমানে সাঁতার কাটা ছাড়াও পানির নীচে কাজ করতে চশমা ব্যবহার করে থাকে।

তারা মাছ ধরা, মুক্তা সংগ্রহ এবং অ্যামবার্গিসের সন্ধানের জন্য পানির নীচে কাজ করে। অতীতে মাছ ধরতে খুব কমই জাল ব্যবহার করত তারা। তবে এখন তারা বিভিন্ন ধরনের মাছ ধরার জাল ব্যবহার করেছে।
যখন সৈকত বা দ্বীপপুঞ্জের নিকটবর্তী আবহাওয়া খারাপ থাকে তখন তারা অন্যান্য কাজ করে থাকে। তবে সেলুনরা কৃষি কাজ করে না।

আমাদের বিষণ্ণতার জন্য কি রিলসপ্রেম দায়ী

সেলুনদের পোশাক

অতীতে সেলুনরা কোনো পোশাকই পরত না। তবে এখন তারা বিভিন্ন রং এবং আকারের পোশাক পরতে শুরু করেছে। নারীরা মাথা থেকে পা পর্যন্ত পুরোপুরি ঢেকে রাখে। তবে অনেক বিবাহিত নারী শরীরের উপরের অংশ খালি রাখে। সেলুনের পুরুষরা লুঙ্গি এবং ছোট প্যান্ট পরে। তবে শরীরের উপরের অংশে তারা কোনো পোশাক পরে না।

তাদের ধারণা, খালি গায়ে থাকলে কোনো অসুখ তাদের ধারে কাছে আসবে না। সমুদ্রে থাকার কারণে সেলুনদের ত্বকের বর্ণ বেশিরভাগেরই বাদামি রঙের হয়ে গেছে। তবে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করছে সেলুনরা। সেলুনের পুরুষদের অনেককেই এখন শার্ট, শর্টস, প্যান্ট এবং বিভিন্ন রঙের জ্যাকেট পরা দেখা যায়।

তাদের খাবার

সেলুনরা বেশিরভাগ সামুদ্রিক খাবারই খেয়ে থাকে। এছাড়াও তারা মুলা ও সরিষা সব খাবারেই ব্যবহার করে থাকে। সেলুনরা রান্নায় খুব কম তেল ব্যবহার করে। সেলুনরা তাদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে অন্য জাতির লোকদের সঙ্গে মেশে না।

 

সেলুনদের ধর্ম

সেলুনদের ধর্মীয় বিশ্বাস নাট (আত্মা) উপাসনা। দুতার-নাট তাদের কাছে মহৎ। তাদের ধারণা, এটি দ্বীপপুঞ্জের দুর্ভাগ্য কাটিয়ে প্রফুল্লতা নিয়ে আসে। এই উপাসনায় অংশগ্রহণকারীরা একের পর এক লাইন ধরে বসে কাঁদতে থাকে। তারা যখন সমুদ্রের প্রান্তে পৌঁছে যায়, তখন তারা মন্দ আত্মাকে তাড়িয়ে দেয়ার জন্য জোরে চিৎকার করে।

সেলুনদের প্রধান উৎসবে তারা আত্মাকে সম্মান জানায়। এজন্য নাট-পরামর্শদাতা মাছ ও মদ পান করেন। তারপর তিনি এবং তার সঙ্গীরা বাদশার পূজা করেন। যখন তার কাছে থাকা এই আত্মা চলে যায় তখন সে ক্লান্ত হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। এভাবেই সেলুনের মানুষরা আত্মার পুজা করে থাকে।

সেলুনদের বিয়ে

সেলুনরা সাধারণত একবারই বিবাহ করে থাকে। তবে বিয়ের আগে ছেলে মেয়েকে প্রেমের সম্পর্কে থাকতে হবে বেশ কয়েক বছর। পরিবারকে জানানোর পর তারাই বিয়ের সিদ্ধান্ত দেবে। ছেলের পিতামাতার পক্ষ থেকে পাঠানো পান-সুপারি কনের পক্ষ গ্রহণ করা মানে তারা এ বিয়েতে রাজি। এখানে আবার একজন নাট-পরামর্শদাতা বিবাহের বৈধতা দেয়ার জন্য বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন।

 

 

সেলুন উপজাতিরা অনেক কষ্ট করে জীবন ধারণ করে

এরপর কনে তার পিতাকে অনুসরণ করে তার নতুন পরিবারের জন্য একটি হাতের কারুকাজ করা নৌকা তৈরি করে। সেই নৌকায় করেই তারা শ্বশুর বাড়িতে যায়। জিপসি (সেলুন) নারীরা তাদের মুখে এক ধরনের সাদা রং মাখে। যা তারা সানস্ক্রিন হিসেবে ব্যবহার করে। ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে বৃদ্ধারাও এটি তাদের মুখে মাখে।

তাদের রয়েছে কিছু পুরনো রীতি

১৯৬৪ সালে একটি অনুসন্ধান অনুসারে, সেলুনের লোকেরা কোনো শিশু জন্ম নিলে সেই মুহূর্তে শিশুর নাভি কেটে ফেলে এবং তিনবার শিশুটিকে গোসল করায়। তাদের ধারণা, এমন করলে পরবর্তীতে শিশুটি সাঁতার কাটাতে পারদর্শী হবে এবং ভয় পাবে না। এই ভুল বিশ্বাস বা কুসংস্কার পালন করতে গিয়ে অনেক শিশু জন্মের পর পরই মারা যায়। তবে এখন এসব কুসংস্কার থেকে সেলুনরা বেরিয়ে এসেছে। এখন শিশুরা যাতে সুস্থভাবে জন্মাতে পারে এজন্য গর্ভবতী নারীদের নিকটস্থ ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে ছেলে শিশু জন্ম নিলে সেই পরিবার অন্যদের থেকে আলাদা থাকে।

 

পানির মধ্যেই তারা টিনের ঘর তৈরি করে

সেলুনরা দল বেধে থাকতে পছন্দ করে। সেলুন জাতির মধ্যে ব্যভিচার একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। যদি কোনো ব্যক্তি ব্যভিচার করে তবে তাকে সম্প্রদায় থেকে বহিষ্কার করা হয়। সম্প্রদায় থেকে বহিষ্কারের ভয়ে সেলুনরা ব্যভিচারে জড়ায় না। সেলুনরা প্রায় সব কিছুতেই তাদের আত্মার উপর নির্ভর করে। তাদের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে নেট-পরামর্শদাতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে এবং সাধারণত বিড়ালদের পূজা করে। তবে এখন কিছু সেলুন চিকিৎসার জন্য ক্লিনিকে যান। আবার অনেকে নাট-পরামর্শদাতাদের সঙ্গে পরামর্শের পরে আত্মার উপাসনা চালিয়ে যান।

বেশিরভাগ সেলুন ম্যালেরিয়া এবং অপুষ্টিতে ভোগেন। সেলুনের লোকেরা বছরে একবার তাদের খোদাই করা নৌকা এবং মোটর নৌকাগুলো মেরামত করে। এসময় পুরনো নৌকার বাইরের অংশ থেকে বিভিন্ন জিনিস কেটে নেয়া হয়। আর নতুন জায়গায় সেগুলো প্রতিস্থাপন করা হয়। পুরো সম্প্রদায়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নৌকা মেরামত করতে পাঁচ দিন সময় লাগে। সেলুনরা মৃতদেহ মাটিতে কবর দেয় না। দূরের কোনো দ্বীপের একটি ওয়াচ টাওয়ারে রেখে দেয়।

 

সেলুনদের শিশুরাও এভাবেই বিশাল জলরাশির মধ্যে বেড়ে ওঠে

আর যদি দ্বীপ থেকে দূরে গিয়ে কারো মৃত্যু হয় তাহলে তাকে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেয়া হত। তবে যদি কোনো নৌকার মালিক মারা যায়। তবে তাকে ভাসিয়ে দেয়ার জন্য তার নৌকাকে অর্ধেক করে কেটে ফেলা হত। এসব রীতি এখন পুরনো। সেলুনরা এখন মৃতদেহকে মাটিতেই সমাধিস্থ করছে। সেলুন উপজাতি উৎপত্তির শুরু থেকেই বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করে চলেছে। নানা অবহেলা আর কুসংস্কারের জন্য এ জাতি এখন প্রায় বিলুপ্তের পথে।

তবে আঞ্চলিক সরকার তাদের ঐতিহ্য, পোশাক এবং জীবনধারা সংরক্ষণে পদক্ষেপ নিচ্ছে। সেলুন জাতির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, রীতিনীতি এবং প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজন শিক্ষামূলক আলোচনা। সেলুন উপজাতি যেমন বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করছে তা সবার জানা প্রয়োজন। এছাড়াও তাদের একাত্মতা এবং কঠোর পরিশ্রম অন্যদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় হয়ে উঠতে পারে। এরা যেসব স্থানে বসবাস করে সেসব এলাকায় দর্শণার্থীর আনাগোণা বেশি থাকে। কারণ তাদের জীবনযাপন পদ্ধতি সবাইকেই মুগ্ধ করে।

ফেসবুক পেজ

এরপরও আপনাদের কোর প্রকার অভিযোগ থাকলে Contact Us মেনুতে আপনার অভিযোগ জানাতে পারেন,

আমরা আপনাদের অভিযোগ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করব।

Spread the love

Check Also

iPhone 16 Pro: A New Experience with ProMotion Display and Enhanced Performance

One of the most popular smartphones in the world today is the iPhone. Apple continually …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *